রোখসানার স্বামীর একেকবার একেক কথা

ভারতীয় নাগরিক রোখসানা আকতারের স্বামী আবদুল হককে আটক করেছে রাজধানীর সরকারি রেলওয়ে থানার (জিআরপি) পুলিশ। গতকাল শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে আবদুল হককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা থেকে আটক করে পুলিশ।

জিআরপি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াছিন ফারুক মজুমদার আজ শনিবার প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, আবদুল গতকাল রাত থেকে থানায় আটক আছেন। আদালতে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। প্রথম আলোর অনলাইনে প্রকাশিত ‘রোখসানার ননদের ঢাকার বাসার খোঁজ মিলেছে’ শীর্ষক সংবাদের সূত্র ধরে আবদুলের বোনের স্বামী সোলেমানের সহায়তায় আবদুলকে আটক করা সম্ভব হয়েছে বলে উল্লেখ করেন ইয়াছিন ফারুক মজুমদার।

আজ দুপুরে কমলাপুর স্টেশনে অবস্থিত জিআরপি থানায় গিয়ে পুলিশের হেফাজতে থাকা আবদুলের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তিনি একেকবার একেক কথা বলতে থাকেন। তবে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ফেলে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। স্ত্রীকে ট্রেনে তুলে দিয়ে সিগারেট কেনার নাম করে তিনি ট্রেন থেকে নেমে যান বলে জানিয়েছেন পুলিশকে। তবে আবদুল প্রথম আলোকে বলেন অন্য কথা। তিনি বলেন, ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার কিছুক্ষণ আগে স্ত্রী পানি খেতে চান। পানি কেনার জন্য ট্রেন থেকে নামলে ট্রেন ছেড়ে দেয়। তারপর নারায়ণগঞ্জ এবং স্টেশনে এসে স্ত্রীকে আর খুঁজে পাননি। পরে গণমাধ্যমের খবরে দেখে জেনেছেন, তাঁর স্ত্রী শৌচাগারে সন্তান প্রসব করেছেন। কিন্তু পুলিশের ভয়ে তিনি আর যোগাযোগ করেননি।

তবে স্ত্রীর প্রসবজনিত কারণে শারীরিক জটিলতা দেখা দেওয়ার পর তাঁকে হাসপাতালে না নিয়ে ট্রেনে কেন উঠলেন-প্রথম আলোর এ প্রশ্নের উত্তরে আবদুল বলেন, ‘আমার কাছে টাকা ছিল না। আর তখন আমার মাথারও ঠিক ছিল না। তাই কী করছি তা মনে নাই।’

রোখসানা ও তাঁর সন্তান বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আবদুল বলেন, ১৮ জুন রাজধানীর আজিমপুরে কবরস্থানের কাছে বোনের বাসা থেকে স্ত্রী ও বোনকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে আজিমপুর ম্যাটারনিটি হাসপাতালে যান। সেখানকার চিকিৎসক রোখসানাকে পরীক্ষা করে জানান, পেটের সন্তানের অবস্থা ভালো না। এরপর রাতে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার জন্য স্টেশনে এসে ট্রেনে ওঠেন। নারায়ণগঞ্জ কেন যেতে চাইছিলেন বা কার কাছে যাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছিলেন, তার কোনো উত্তর দিতে পারেননি আবদুল।
জিআরপি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াছিন ফারুক মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ট্রেনের কর্মী এবং থানায় কর্মরতদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৮ জুন রাতে ট্রেনটি নারায়ণগঞ্জে পৌঁছানোর পর সব যাত্রী নেমে গেলে কর্মীরা যখন ট্রেনের বগি চেক করতে যান, তখন রোখসানাকে দেখতে পান। তিনি কান্নাকাটি করছিলেন। কিন্তু কেউ তাঁর ভাষা বুঝতে পারছিলেন না। পরে ট্রেনের এটিএস আশিষ গোস্বামীর সহায়তায় হিন্দি ভাষায় রোখসানার সঙ্গে কথা বলে ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারেন। পরে ট্রেনে করেই রোখসানাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় আনা হয়। রাত প্রায় একটার দিকে জিআরপি থানার সামনে এসে রোখসানা শৌচাগারে যেতে চান। ট্রেনের লোকজন এবং থানার প্রহরী আলাউদ্দিনের সহায়তায় থানার অফিসার ও ফোর্সরা যে শৌচাগার ব্যবহার করেন, তাতে যান রোখসানা। শৌচাগার থেকে অনেকক্ষণ পরেও তিনি বের না হওয়ায় থানার কর্মরত নারী কনস্টেবল ও স্টেশনের মানুষজনের সহায়তায় শৌচাগার থেকে রোখসানা ও নবজাতককে উদ্ধার করা হয়। মা ও নবজাতককে প্রথমে মুগদা জেনারেল হাসপাতাল এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রোখসানার সন্তানের জন্ডিসসহ নানা জটিলতা দেখা দেওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্পেশাল কেয়ার বেবি ইউনিটে (স্ক্যাবু) ভর্তি করা হয়েছে। রোখসানা জিআরপি থানার পুলিশি প্রহরায় ভর্তি আছেন স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিভাগের ওয়ার্ডে।
এর আগে রোখসানা হাসপাতালে বসে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, পেটের সন্তান মারা গেছে জেনে স্বামী আবদুল ও তাঁর বোন নিলু তাঁকে স্টেশনে ফেলে চলে যান। স্বামীর কাছেই তাঁর পাসপোর্ট আছে। তবে আবদুল প্রথম আলোকে বলেন, রোখসানার কোনো পাসপোর্ট নেই। বেনাপোলে দালালকে ছয় হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে তাঁরা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন।ভারতীয় নাগরিক রোখসানা আকতারের স্বামী আবদুল হক। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। ছবি: মানসুরা হোসাইনভারতীয় নাগরিক রোখসানা আকতারের স্বামী আবদুল হক। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। ছবি: মানসুরা হোসাইন

কোন আইনে মামলা হবে

আবদুল আটক হলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোন আইনে মামলা হবে, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। জিআরপি থানার ওসি ইয়াছিন ফারুক মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, আবদুল স্ত্রীর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, এ অভিযোগে তাঁর স্ত্রী মামলা করতে পারেন। অন্যদিকে ভারতীয় নাগরিক রোখসানার পাসপোর্ট না থেকে থাকলে বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে রোখসানার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। ভারতীয় হাইকমিশনকে পুরো বিষয় জানানো হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরসহ সবাই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছেন। আবদুলকে আদালতে পাঠানোর পর আদালত যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর রোখসানার শারীরিক কোনো জটিলতা না থাকায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে রিলিজ দিয়ে দিতে চাইছে। এখান থেকে রিলিজ দিলে রোখসানাকে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হবে। রোখসানার সন্তান যত দিন সুস্থ না হয়, তত দিন হাসপাতালেই ভর্তি থাকবে।

পুলিশের কাছে আবদুলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে আবদুল হক (৩৩) অবৈধভাবে ভারতে যান স্ত্রীসহ। তিনি প্রথম বিয়ে করেছিলেন বাংলাদেশেই। ওই ঘরে তাঁদের কোনো সন্তান নেই। তারপর বেঙ্গালুরুতে আসবাবের কাজ করার সময় রোখসানার সঙ্গে পরিচয়। দেড় বছর আগে রোখসানাকে বিয়ে করেন। বিয়ে করার কয়েক মাস পরে রোখসানার পরিবার এবং আবদুলের প্রথম স্ত্রী বিষয়টি জানতে পারেন। প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে একসঙ্গেই থাকতেন আবদুল। ২ জুন রোখসানাকে নিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন আবদুল। তারপর কখনো চট্টগ্রাম, কখনো ঢাকায় বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাসায় তাঁরা থাকেন। আবদুলের বাড়ি চাঁদপুরের মতলবে।